বইটির প্রচ্ছদ |
কাজী আনিস উদ্দিন ইকবাল পেশায় একজন স্থপতি। যশোর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। তিনি ‘স্থাপত্য ও নির্মাণ’ ওয়েব পত্রিকার সম্পাদক। স্থাপত্য ও শিল্পকলা বিষয়ে লেখালেখি করতে পছন্দ করেন। তিনি দেশের প্রখ্যাত ডেভেলপার কোম্পানি, বিল্ডিং ফর ফিউচার লিঃ- এর একজন উদ্যোক্তা, এছাড়াও দেশের নির্মাণ ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তি আমদানি করে এ দেশের স্থপতিদের সৃষ্টির জগৎকে প্রসারিত করেছেন। |
|
বইয়ের নাম: আধুনিক স্থাপত্যধারার চার মহানায়ক লেখক: কাজী আনিস উদ্দিন ইকবাল প্রকাশের তারিখ: ০৮ আগস্ট, ২০২৩ প্রকাশকের নাম: স্বর্ণালী পাবলিশার্স লিঃ পরিবেশক: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড পৃষ্ঠা: ১৫০ ISBN: 978-984-95175-7-3 |
বই সংক্রান্ত আলোচনা: নাসরিন জাকিয়া সুলতানা |
পাঠোত্তর অনুভূতির প্রকাশ ‘অনুভূতির প্রকাশ’ শব্দদুটো অনেক ভেবেচিন্তে লিখেছি। কারণ বইয়ের বিষয়বস্তু আমার সম্পূর্ণ অজানা জগতকে নিয়ে লেখা। স্থাপত্য এক ধরনের শিল্প – এ ব্যাপরে কোন সন্দেহ নেই। শিল্পের প্রতি, না ঠিক শিল্প বললে অসম্পূর্ণ বলা হবে, শিল্প জগতের প্রতি আমার টান অনেক ছোটবেলা থেকে। ছবি আঁকা থেকে শুরু করে সঙ্গীত, নৃত্য এসব কিছুর সান্নিধ্যে আসতে যেমন ভালোলাগে, তেমনই তা আমি উপভোগ করি যতটা আমার বৌদ্ধিকতায় কুলোয়। বেশি মাতব্বরি আমি করতে যাই না, কারণ এর কোন একটিতেও আমার অনুপ্রবেশ তো দূরের কথা, সংস্পর্শও নেই। কিন্তু স্থাপত্য? শিল্পের জগতে সে তো ভয়ানক এক জায়গা দখল করে আছে। কোন স্থাপত্য কীর্তি আমার দেখতে ভালোলাগে, দেখি। সে সম্পর্কে যদি কিছু বলতে ইচ্ছে হয় তো নিজেকে বলি। কোন মূর্তি গড়া থেকে ইমারত গড়ে তোলার পেছনে কত শত কৌশল এবং যৌক্তিক কল্পনা প্রয়োজন হয়েছে, তা হিসেব করা কি কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব? আমি তা কখনোই মনে করি না। |
|
|
যাক এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। এই বইটি হাতে পাওয়ার পর একটু সাহস হল, দেখি না পড়ে। বইটি আমাকে দিয়েছেন স্বয়ং লেখক, তিনি একজন স্থপতি। ভাবলাম কতদূর পড়তে পারি দেখি। শুরু করলাম পূর্বাভাস দিয়ে। লেখক যা লিখছেন প্রথমদিকে তা বেশ আপন পরিবেশ সংক্রান্ত মনে হলো। ঐতিহাসিক বাড়িঘরদুয়োর অমরা ঘটা করে দেখতে যাই, দেখি আর বলি, বাব্বাহ! কী কারুকাজ, কত সূক্ষ ছিল নির্মাণ কর্মীর হাতের কাজ এবং সেইসাথে তার মনের বৈচিত্র্য ও গভীরতা! মানুষ বা পশু পাখির ভঙিমা এবং অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা কি সহজ কাজ? কিন্তু এ কথা কি আমরা একবারো ভাবি বা ভেবেছি বসবাসের জন্য যে বাড়িটি তৈরি করা হয়েছে তার জন্য বিশেষ সুবিধা কতটা রয়েছে ঐসব ইমারতে? |
হ্যাঁ বসবাস বা কাজের জন্য এই সুবিধাজনক বিবেচনা বা প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবলেন আধুনিক স্থপতিরা। যেমন একটি স্কুল বা হাসপাতাল বা বাসযোগ্য বাড়ি, যাই নির্মাণ করতে যাওয়া হ’ক না কেন ঐ উদ্দেশ্য এবং তার বাস্তবায়ন কতটা প্রয়োগ করা যাবে বা করা হলো, তা নিয়ে ভাবলেন এই আধুনিক স্থপতিরা। আদিকালের ঘরবাড়িগুলো শৈল্পিক জগতে তাদের মহিমা নিয়ে দাড়িয়ে আছে, থাক। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আধুনিক এই স্থপতিদের চিন্তার গভীরতা আরো ব্যপক ও বিস্তৃত হতে শুরু করল, এ কথাই বলছেন লেখক। সাধারণভাবে শিল্পী যা দেখেন স্মৃতি রোমন্থন করে তাই প্রকাশ করেন তার চিত্রে বা ইমারত নির্মাণে। তাই আঁকেন তারা। এখানে উপলব্ধি বা বোধগম্যতার শৈল্পিক প্রকাশের স্থান ছিল নগন্য। কিন্তু আধুনিক যুগে এল শিল্পীর কল্পনাপ্রসূত সৃষ্টির জয়জয়োকার। না আমি ভুল বলেছি, কল্পনা তো বটেই, কী উদ্দেশ্যে নির্মিত হবে সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ালো।
স্থাপত্য শিল্প বটে কিন্তু তার যেন সমাজ, নগর, মানুষের জীবনধারা, এমনকি রাজনৈতিকতার জয় পরাজয় সব কিছুর দায় রয়েছে তার উপর। আমরা বলি সাজানো গোছানো নগর, বাড়ি বা সুবিধাজনক কর্মক্ষেত্র, এসবই আধুনিক স্থাপত্যধারার দান। লেখক চারজন আধুনিক স্থপতির চিন্তাধারা ও তার উৎস, গবেষণা, তাদের কর্ম, এবং কাজ করতে গিয়ে তাদের সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি আলোচনা করেছেন। তাদের কথা খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে একটু বলার চেষ্টা করছি। |
ফ্র্যাংক লয়েড রাইট রাইটের একটা কথা শুনি, তিনি বলছেন, ”ঐতিহ্য না প্রয়োজনটাই বড়” ঐতিহ্যপূর্ণ ঘরবাড়ির ধারণাকে তিনি ত্যাগ করলেন বা মানলেন না। তার কথা ছিল বাড়ি বা ভবনের প্রতিটি স্পেসের যৌক্তিকতা থাকবে অর্থাৎ তা যেন প্রয়োজনীয় হয়, কাজে লাগে। শুধুই দেখবার উপাদান যেন না হয়। নির্মাণ শিল্পে তার দর্শনের কিছু ধারা ছিল। সংক্ষিপ্ত সময়ে তা আলোচনার প্রয়োজন বোধ করছি না। তবে ভিন্নধারা যে গৃহ তিনি উদ্ভাবন করলেন, তার নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘প্রেইরি হাউস’। এর বৈশিষ্ট ছিল খোলামেলা ভাব। বাড়ির প্রতিটি স্পেসে একই স্বরে একই সুর বাজবে। চমৎকার এ কথাটি তুলে ধরেছেন লেখক। রাইট একজন উদ্যোক্তাই শুধু নন, তার নিজস্ব দর্শন ছিল। তিনি গর্বিত এ জন্যে যে, তার দর্শন স্থায়ী হবে। হয়তো বাড়ি ভেঙে যাবে, সৃষ্টি ধ্বংস হবে কিন্তু তার মৌলিক চিন্তাধারা রয়ে যাবে অনন্তকাল। আজকাল আমরা যে সব ঘরবাড়ি দেখছি, সেটাই তো প্রমাণ হয় তাই না? তাই তিনি ‘অমর’ বলে স্বীকৃত। |
|
মিইজ ভ্যানডের রোহ |
মিইজ ভ্যানডের রোহ শিল্প চর্চায় যে একঘেয়েমী ছিল, যেমন কোন বাস্তবতার চিত্র আঁকা বা শুধুই বসবাসের জন্য কোনমতে একটি ঘর বানানো মিইজ এর বিরোধীতা করলেন। কল্পনার আবির্ভাব হল তবে যৌক্তিকতাকে উড়িয়ে দিয়ে না। একটা কথা আমার খুব ভালো লেগেছে, তা এই যে, অন্যান্য শিল্পীদের কাজে শুধুই ভাব বা কল্পনা থাকতে পারে, কিন্তু স্থাপত্য শিল্পের বাস্তব প্রয়োগ চাই। লাইব্রেরী, হাসপাতাল, বিদ্যালয় ভবনের পৃথক পৃথক উদ্দেশ্য। এই পৃথক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে স্থপতি তার নকশা করবেন। শিল্পী সব সময়ই যুদ্ধবিরোধী। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর শিল্প সাহিত্যে তাইই প্রকাশিত হতে লাগলো। স্ফটিকের আলোর উচ্ছাস, কাচের স্বচ্ছতা এসবের ব্যবহারে মিইজ মনোযোগ দিয়েছিলেন। পাথর খোদাই না, বরং নির্মাণ শিল্পে তিনি লোহা আর কাচের ব্যবহারকে সমাদরে স্থান দিলেন। তিনি বলছেন, ”আমাদের নির্মাণ পদ্ধতি এখন শিল্পায়িত হওয়া দরকার।” |
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিইজের মধ্যে আধুনিক স্থাপত্য শিল্পকলার ধারণার উণ্মেষ ঘটে। তিনি অনেক অনেক ঘরবাড়ি তৈরি করেননি তবে আধুনিক ধারণার মিশ্রণের পরে তিনি বহু বহু ক্ষেত্রে তার মৌলিক চিন্তা ধারার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। |
লে কর্বুযিয়ে |
লে কর্বুযিয়ে লে কর্বুযিয়ে যেন একটু বেশি ভাবুক ছিলেন, একটু বেশি রোমান্টিক। তাই শুনতে পাই তিনি বলছেন,নির্মাণ শিল্পে সব পরিকল্পনাই হবে অন্তরের সৃষ্টি প্রেরণার ফল। ইট, কাঠ, পাথর, কাচ যাই হোক না কেন তিনি মুল্য দিয়েছেন তার ভালোলাগার আবেশকে, হৃদয়ের স্পন্দনকে। তাই বলে তিনি বাস্তবতাকে গ্রাহ্য করেননি, তা না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং সেসব দেশের নানারকম প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মের সাথে তিনি সম্যক ধারণা নিয়েছেন।
ফলে মানুষের ক্লান্তিকর, একঘেয়ে মানসিক অবস্থা থেকে তাকে টেনে বের করে ভবনের ভিতরে বাইরের আমেজটা নিয়ে আসার আকাঙ্খা থেকে ভিতরের ভারী দেয়ালগুলো সরিয়ে কাচের ব্যবহার করলেন। ফলে চার দেয়ালের মধ্যে দম আটকে থাকার পরিবেশ দূর হল। |
লুইস. আই. কা’ন ইহুদী সম্পদায়ে লুয়ের পরিবারের একটা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ স্থান ছিল। ধারণা করা হয় সেই কারণেই লুইয়ের মানসিকতার বিকাশ খুব সাধারণ না বরং বেশ উঁচু স্তরে অবস্থান করত। একটা চমৎকার কথা আমি বইয়ে পেয়েছি, তা হ’ল, কর্মক্ষেত্রে আমরা নিঃশব্দতার অবগাহনে পরাণের গহীন থেকে তার আলোর পরিসর সৃষ্টির রহস্যময় স্থাপত্য বারবার অনুধাবন করব। কথাটিকে আমি শতভাগ সমর্থন করি। লুই ইসাডোর কা’নকে আমরা কে না চিনি? আমাদের সংসদ ভবনের স্থপতি তিনি। অনেকেই লুইকে আধুনিক ধারার স্থপতি মানতে রাজী হন না। কারণ তিনি আধুনিক ধারার সকল শর্ত মেনে কাজ করেননি। হাজার বছরের নির্মাণ ঐতিহ্যকে তিনি নতুন কৌশলের মধ্য দিয়ে ধরে রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু ভবন কাঠামোর প্রযুক্তি, শিল্পজাত নির্মাণ উপাদনের ব্যবহার, সেইসাথে তত্ত্বগতভাবে ভবনকে ব্যবহারকারীদের জন্য উপযোগী করে গড়ার প্রয়াসও তার ছিল।আধুনিকতাকে শুধুই পদ্ধতি মনে করতেন না তিনি। বরং আধুনিকতাকে মানুষের ক্রমপরিবর্তনশীল চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে হবে। এই ছিল তার চিন্তাধারার উৎস। |
লুইস.আই.কা'ন |
আধুনিক স্থপতি হিসেবে লেখক আরো অনেক নাম উল্লেখ করেছেন। তাদের নানা কীর্তি, নানা শৈল্পিকবোধ ও তার স্তরভেদ, নানা প্রয়োজনে নানারূপের ইমারতের উল্লেখ করেছেন। আমি সেসব নাম উল্লেখ করতে গেলাম না। বইটি পড়ে এবং ভেতরে অনেক অনেক ছবি, নকশা দেখতে দেখতে শুধু এটাই ভাবছিলাম আদিম কালে মানুষ যখন গুহায় বাস করত তখন, তারা গৃহকোন তৈরি করে তার গায়ে নানা রকম চিত্র বা ছবি এঁকেছে চিত্তাকর্ষক করে তোলার জন্যে। তারপরে রাজাবাদশা, নবাবদের যুগে তারই ধারাবাহিকতায় শক্ত, টেকশই, মজবুত (যেন শত্রুপক্ষ ধ্বংস না করতে পারে) বাড়িঘর বানিয়ে তার প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে বা বাইরে নানান রকম আঁকিবুকি করেছে নান্দনিক করে তোলার প্রয়োজনে। গৃহ নির্মাণের এই আধুনিক কালেও স্থপতিরা নানান রকম প্রযুক্তির ব্যবহারে হালকা উপাদান ও উকরণের সমন্বয়ে মজবুত ইমারতই গড়ছেন কিন্তু নান্দনিকতাকে কেউ এড়িয়ে যাননি। শিল্প সব সময়ই জয়ী হয়েছে। হতে পারে তার প্রকৃতি, আকার এবং তার প্রকাশের ধরণ বদলে গেছে। তবে স্থাপত্য শিল্প যতই প্রয়োজন এবং উদ্দেশ্যকে গুরুত্ব দিক না কেন, সৌন্দর্যকে এড়িয়ে যায়নি, শিল্প কখনোই অবহেলিত হয়নি। |
আমার এই লেখাকে এই জগতের সম্মানিত ব্যাক্তিবর্গ হয়তো স্পর্ধা মনে করবেন। কারণ যা আমি লিখেছি এবং যেমন করে লিখেছি তা অপ্রতুল, আমি জানি। কিন্তু শিক্ষা জগতে কোন বিষয়ের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ বা অকারণ হতে পারে না। বইটি পড়ে অমি এই কথাটিতে বিশ্বাস করার আরো জোর পেয়েছি। আমার মত আর যারা পড়বেন তারাও নিশ্চয়ই আমাকে সমর্থন করবেন। |